“গুণগত শিক্ষা লাভ করা গরিবদের জন্য নয়। এটি ধনীদের বস্তু।” এই কথাটি লোকে-মুখে শুনে এবং এর করুণ বাস্তবতা দেখতে দেখতে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার জন্ম দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল থানচি হলেও বেড়ে উঠি রাঙ্গামাটির একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে। অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি, ছোটবেলা থেকে পরিবারকে ছেড়ে আবাসিক বিদ্যালয়ে যাদের পড়তে হয়, তাদের মত অভাগা আর নেই। কিন্তু আমার এবং আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য তা ছিলো সৌভাগ্যবানদের আশ্রয়স্থল। কারন, সেখানে ন্যুনতম খরচে পড়ার সুযোগ না হলে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা হয়তো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো।
ছোটবেলা থেকেই নিজের এলাকার এবং পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের শিক্ষায় অনগ্রসরতার করুণ বাস্তবতা অনুধাবন করে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছাকে লালন করে আসছি। আমার দীর্ঘদিনের এই অভিপ্রায় স্নাতক শিক্ষাজীবনের চতুর্থ বর্ষে এসে যেন দিশা খুঁজে পায়। তখন ২০১৮ সন, যখন টিইচ ফর বাংলাদেশের অবহেলিত শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের চিন্তা ও অঙ্গীকার সম্পর্কে জানতে পারি। আমি তখনই আবেদনের জন্য নিবন্ধন করে ফেলি এবং পরের বছর থেকে সুবিধাবঞ্চিত একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই।
দুই বছরের ফেলোশিপে আমার দারুণ কিছু অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে বুঝার ও অনুধাবন করার সুযোগ হয়। মানসম্মত শিক্ষাদান এবং শিক্ষার্থীদের কমিউনিটিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কমিউনিটি প্রজেক্ট করা ছিলো ফেলোশিপের কাজ। কাজ করতে যেয়ে যখনই শিক্ষার্থীদের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি তখনই মন আনন্দে ভরে যেতো আমার। খুব অনুপ্রাণিত বোধ করতাম। তেমনই একটি প্রজেক্ট ছিলো “আনন্দ শিশু পাঠাগার” নামক শিশুতোষ বই সম্বলিত একটি পাঠাগার স্থাপন করা। কোভিড-১৯ ভাইরাসের ভয়াবহতার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্য উপকরণ বিতরণ, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ এবং এরকম আরো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করি। আমরা ১৭ টি বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোর ও তাদের পরিবারের সহযোগীতা করেছিলাম, যা আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
বর্তমানে আমি CRDC: Community Resource Development Center এর Founder and CEO হিসেবে কাজ করছি। ফেলোশিপে লব্ধ প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমি এবং আমার টিম মানসম্মত শিক্ষাদানের লক্ষ্যে একটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করেছি। এর পাশাপাশি Climate Change and Adaptation নিয়ে শিশুদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে একটি Climate Learning Hub স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এর পাশাপাশি Helping Hands প্লাটফর্মের মাধ্যমে আমরা যেকোন দূর্যোগ ও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে দুঃস্থদের সহায়তা করতে কাজ করে যাচ্ছি।
আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। দিনটিকে আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের কিছু উদ্দেশ্য হলো আদিবাসীদের উপর হয়ে আসা অন্যায় সমূহ স্মরণ করা, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ করা। কিন্তু দুঃজনক হলো আদিবাসীরা আজও অধিকাংশ নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং মূল ধারার জনগোষ্ঠী থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। আমি দৃঢ় আশাবাদী যে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রজন্ম জাতি, ধর্ম, বর্ণ বিভেদ না করে যেকোন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এবং সমাধানের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিবে।”